এক সময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। ধীরে ধীরে সেই জায়গা দখল করে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে পোশাক খাত। এরপরেই ছিল চামড়া শিল্প। তবে করোনায় পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা কমে আসায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল দেশের রপ্তানি খাত।
বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও চামড়া রপ্তানি। তবে রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে করোনা জয় করেছে ছোট কিছু পণ্য। লকডাউন, কারখানা বন্ধ এমনকি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের মতো নেতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো এসব খাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
দেশের ৭৫০টি পণ্য নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। তবে করোনাকালে একেবারেই নতুন পণ্য হিসেবে রপ্তানি খাতে আয় বাড়িয়েছে অপ্রচলিত বেশ কিছু পণ্য। আশার আলো দেখানো এসব পণ্য হচ্ছে- ওষুধ, ফলমূল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাঁচা পাট, শাক-সবজি, জুতা (চামড়া ব্যতীত), আসবাব, কার্পেট, জুট ইয়ার্ন এন্ড টোয়াইন, গলফ শ্যাফট, তামাক, জাহাজ, চা, হ্যান্ডিক্রাফট, ছাই। এসব পণ্য রপ্তানি করে গত অর্থবছরে আয় হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার।
আয়ের পাশাপাশি রীতিমতো বৈচিত্র্য এনেছে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী পণ্য। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের চাহিদা এখন তুঙ্গে।
অপ্রচলিত এসব পণ্য নগদ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবছে সরকার। নগদ প্রণোদনা দিতে স¤প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ২১টি প্রস্তাব দিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশের ৭৫০টি পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৬০০ পণ্য বাড়তি সুযোগ পায়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওষুধ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ, জুতায় (চামড়া ব্যতীত) ২ দশমিক ৬ শতাংশ, হ্যান্ডিক্রাফট পণ্য ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ, পাট ও পাটজাত পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি, কাঁচা পাট ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, চা রপ্তানিতে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ, কার্পেটে ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রকৌশল যন্ত্রাংশ ২৬ শতাংশ।
এছাড়া জুট ইয়ার্ন এন্ড টোয়াইন পণ্যে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ, গলফ শ্যাফট পণ্যে ২০ শতাংশ, তামাকে ২৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, জাহাজে ১৩৯ শতাংশ, ফলমূল রপ্তানিতে ৪৮ শতাংশ ও সবজি রপ্তানিতে ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ছাই রপ্তানিতে ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, করোনায় শত প্রতিক‚লতার মধ্যে দেশের রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ছোট পণ্যগুলো বেশ ভালো করছে। সুসংবাদ হলো, করোনায় বিশ্ব যখন টালমাটাল, এ সময়ে বাংলাদেশের এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
তথ্য মতে, রপ্তানিকৃত এসব পণ্য থেকে গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৬৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর মধ্যে ওষুধে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্যে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার, কাঁচা পাটে ১২ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, জুতা (চামড়া ব্যতীত) পণ্যে ২৭ কোটি ৭১ লাখ ডলার, আসবাবে ৭ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, হ্যান্ডিক্রাফট পণ্য ২ কোটি ডলার, ফলমূলে ৪৯ লাখ ডলার, চায়ে ৩১ লাখ ২০ হাজার ডলার, প্রকৌশল যন্ত্রাংশ ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, কার্পেটে ২ কোটি ১১ লাখ ডলার, জুট ইয়ার্ন এন্ড টোয়াইনে ৫৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার, গলফ শ্যাফট ১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, তামাকে ৮ কোটি ডলার, জাহাজে ১ কোটি ১৩ লাখ ডলার, সবজিতে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ছাই রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার আয় হয়েছে।
সুরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি : করোনা পরিস্থিতি রপ্তানি খাতে কিছু সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। রপ্তানি তালিকায় যুক্ত করেছে নতুন কিছু পণ্য। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) হিসেবে চাহিদা বেড়েছে বিশ্বে। বেড়েছে মাস্ক বা মুখোশের ব্যবহার।
মাস্ক ছাড়াও চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের মধ্যে আছে মেডিকার্ট রোবট এবং জীবাণুনাশক রিমোট কন্ট্রোল ইউভি-সি সিস্টেম, ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র, ফেস প্রোটেকটিভ শিল্ড, সেফটি গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মোমিটার। বর্তমানে ঢাকা ও তার আশপাশের সাভার ও গাজীপুরে ৩৩টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও ফেসিয়াল মাস্ক।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মোট ১১ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত মাসে এ পণ্যগুলো বিপুল পরিমাণ রপ্তানি করা হয়। দেশীয় কোম্পানি বেক্সিমকো সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ লাখ মেডিকেল গাউন রপ্তানি করে।
চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটির কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সুরক্ষা উপকরণ রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। নতুন পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আসছে : শুধু পিপিই নয়, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও সলিউশন তৈরি করছে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ওয়ালটন, মিনিস্টার, স্কয়ার ও এসিআইয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অতিসম্প্রতি দেশীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাস ধ্বংস করে এমন কাপড় প্রস্তুতের কথা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন এসব পণ্যের মাধ্যমে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) ওবায়দুল আজম। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে সুরক্ষা উপকরণের মতো পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সুরক্ষা উপকরণ, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, করোনা ধ্বংস করে এমন কাপড় এ পণ্যগুলো রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আগামী এক বছর এ ধরনের পণ্যের চাহিদা থেকেই যাবে।
রপ্তানিতে নতুন চাহিদা : রপ্তানির ক্ষেত্রে অতি সম্প্রতি যে পণ্যটির চাহিদার বিষয়ে বহির্বিশ্ব থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো করোনা ধ্বংস করতে সক্ষম এমন কাপড়। পণ্যটি উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান জাবের এন্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ঘোষণার পরপরই বিদেশে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন।
সুইজারল্যান্ডের দুটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় করোনা বøক নামের এ বিশেষ কাপড় নিজেদের টঙ্গীর কারখানায় উৎপাদন করেছে জাবের এন্ড জোবায়ের।
৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ করোনা ভাইরাস এ কাপড়ের সংস্পর্শে আসার ১২০ সেকেন্ড বা দুই মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাবের এন্ড জোবায়েরের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার অনল রায়হান বলেছেন, আড়াই মাসের পরিশ্রমের ফসল এ করোনা প্রতিরোধী কাপড়। এরই মধ্যে বিদেশের পরীক্ষাগারে আইএসও ১৮১৮৪-এর অধীনে কাপড়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কাপড় বাজারজাত করার জন্য আন্তর্জাতিক মান সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সনদ নিয়েছি।
প্রণোদনার আওতায় আসছে নতুন পণ্য : করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ এবং আমেরিকার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। সামনে আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে সরকার প্রচলিত পণ্যের প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি সম্ভাব্য রপ্তানি পণ্যে নগদ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবছে। কিভাবে ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে টেকসই রপ্তানির জন্য কাজ করা যায় এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে।