Blog Details

img
Share On

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ - তৈরি পোশাক

দেশে রফতানি খাতে ৮৫ শতাংশ অবদান রাখছে তৈরি পোশাক। এখন পর্যন্ত বৃহদায়তনে রফতানির সক্ষমতা গড়ে উঠেছে শুধু এ শিল্পটিতেই। বড় রফতানিকারকরাও এ শিল্পে কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণেও বলা হয়েছে, দেশে তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য শিল্পে ‘সুপারস্টার রফতানিকারক’ নেই বললেই চলে।

 

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন এপ্রিল ২০২৩ সংস্করণ প্রকাশ হয় গত মঙ্গলবার। প্রতিবেদনে বাণিজ্য খাতে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েই তৈরি পোশাকের বাইরে অন্য শিল্পে বৃহৎ রফতানিকারক গড়ে না ওঠার বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়।

 

সংস্থাটির ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের প্রধান শিল্প তৈরি পোশাক খাত বড় হয়েছে মূলত উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার ও সস্তা শ্রমের ওপর ভর করে। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানও এখন এ খাতের ওপরই নির্ভরশীল।

 

বৈশ্বিক তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে অন্যান্য শিল্প বিপাকে পড়লেও সবার আগে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। খাতটির উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হা-মীম, পলমল ও ডিবিএল গ্রুপ। এছাড়া স্কয়ার গ্রুপ, আল-মুসলিম, মণ্ডল, এশিয়ান, একেএইচ, ন্যাচারাল, বিটপি, নিউটেক্স ও ইপিলিয়ন গ্রুপও পোশাক খাতের শীর্ষ রফতানিকারক হিসেবে পরিচিত। মোটা দাগে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ধরা হয় দেশের তৈরি পোশাক খাতের সুপারস্টার রফতানিকারক হিসেবে।

 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানি খাতে সুপারস্টার এখন পর্যন্ত একটাই—তৈরি পোশাক। সম্ভাবনাময় আরো প্রায় কিছু খাত আছে যেমন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য। কিন্তু এরা এখনো এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ে সীমাবদ্ধ। এছাড়া আছে আইটি খাত। এগুলো কোনোটিই সুপারস্টার দূরের কথা স্টারও হতে পারেনি। অর্থনীতির জন্য একটি খাতের ওপর নির্ভরতা ভালো না, এ কথা ঠিক। কিন্তু যদি কর্মসংস্থান বিবেচনায় নেই, তাহলে তুলনামূলক কম বিনিয়োগে এত বড় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কিন্তু আর নেই। অন্য খাত যদি ভালোও করে; তবুও সেসব খাত কিন্তু এত বড় কর্মসংস্থানের জোগানদাতা হতে পারবে না। আমরা চেষ্টা করছি পোশাক খাতের মধ্যেই কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায়। সেই চেষ্টার প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে। আমাদের রফতানি বাজারে বৈচিত্র্য আসছে। নতুন পণ্যের ক্ষেত্রেও যেমন ম্যান মেড ফাইবার ও হাই ভ্যালু প্রডাক্ট পোশাক খাতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। সুতরাং পোশাক খাতে নীতিসহায়তা বাড়াতেই হবে। পাশাপাশি সম্ভাবনা বিকাশের লক্ষ্যে অন্যান্য খাতকেও নীতিসহায়তা দিতে হবে। আমরা চাই রফতানিতে অন্যান্য খাতেও আরো স্টার, সুপারস্টার গড়ে উঠুক।

 

ভূ-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানির বিশাল বাজার হারাচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীন থেকে ক্রমাগত সরিয়ে নিতে চাইছে। এক্ষেত্রে ইউরোপের বিশাল বাজারে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

 

তবে দেশের রফতানি খাত একক একটি পণ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টিতে সার্বিক অর্থনীতির ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো অর্থনীতিতে পণ্য প্রস্তুত ও রফতানির অবদানও এখন দিনে দিনে কমছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ প্রবণতা বজায় রয়েছে। অন্যদিকে মোট জিডিপিতে সেবা বাণিজ্যের অবদান মোটে ৫ শতাংশের কিছু বেশি। সমজাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য দেশের তুলনায় এদিক থেকেও বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ।

 

প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলা হয়, তৈরি পোশাকে অতিনির্ভরতা রফতানি খাতের প্রতিযোগী সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এ নির্ভরতার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পোৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির মডেলটি টেকসই হয়ে উঠতে পারছে না। রফতানির বৈচিত্র্যায়ন আসেনি। রফতানি হয়ে পড়েছে পুরোপুরি পণ্যনির্ভর। সেবা খাত এখানে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংরক্ষণমূলক শিল্প নীতির বড় ভূমিকা রয়েছে। রফতানি বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে বৈচিত্র্যায়নের পাশাপাশি এখন কিছু নীতিগত সংস্কারেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

 

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারাও মনে করছেন, যথাযথ নীতিগত সহায়তা ও সংস্কার পেলে অন্যান্য শিল্প খাতও বৈশ্বিক রফতানি বাজারে বড় ধরনের অবস্থান গড়ে নিতে পারবে।

 

ডেনিম পণ্য রফতানিতে তৈরি পোশাক খাতের আরেক সুপারস্টার প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড ও ইউনিভার্সেল জিন্স লিমিটেড জাতীয় রফতানিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক পেয়ে আসছে। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ এম তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত এখন একটি জায়গায় এসে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খাতটি গুরুত্ব পাবে। এর অর্থ এই নয় অন্য খাতও রফতানিতে ভালো করছে না। পাট ও পাটজাত, ফুটওয়্যার এমনকি ফিশিংয়ের মতো খাতগুলোও রফতানিতে বেশ এগিয়েছে। দেশে এমন অনেক খাতই আছে যেগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম। তবে এসব খাতের বড় পাঁচটি কোম্পানি কীভাবে ৫০টিতে উন্নীত হতে পারে সে জায়গাটি এখনো সেভাবে মনোযোগ পায়নি। আরএমজির মতো করে অন্যান্য খাতও যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে অবস্থান করে নিতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কারের বিষয়টি সরকারের সামনে যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে হবে। যেহেতু আরএমজি খাতটি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে, খাতটি সরকারকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে ভালোভাবে বোঝাতে পারে। এ বিষয়ে সরকারও আন্তরিক।’

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা, যা মোট রফতানির প্রায় ৮৫ শতাংশ। পরের অবস্থানেই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছে ৮ হাজার ৭৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা। সে হিসেবে মোট রফতানিতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। শীর্ষ দুই রফতানি পণ্যের আয়ের এ ব্যবধানের পেছনে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য শিল্পে বৃহৎ রফতানিকারক তৈরি হতে না পারাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশের রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে হলে অন্যান্য পণ্যসংশ্লিষ্ট ট্যারিফ কাঠামোয় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এছাড়া ট্যারিফ বাধাগুলো দূর করার পাশাপাশি সেবা খাত ও বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আরো উদারীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে। শুধু এসব উদ্যোগের বাস্তবায়নেই আগামী অন্তত দেড় দশক জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপর রাখা সম্ভব।

 

দেশের অর্থনীতিবিদরাও বিশ্বব্যাংকের এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক মো. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানি বহুমুখী করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সবাই একমত। রফতানি বৈচিত্র্যায়নে আমরা সেভাবে সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। এটি পোশাক খাত দিয়েই নিয়ন্ত্রিত। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন নীতিসহায়তা এবং আন্তর্জাতিক সহায়ক পরিবেশের কারণে পোশাক খাতের যেভাবে অগ্রগতি হয়েছে, অন্য খাতগুলোয় সেভাবে সাফল্য আসেনি। যেমন চামড়া শিল্প আছে, হালকা প্রকৌশল বা এগ্রো প্রসেসিংয়ে কিছু সাফল্য এলেও তা সীমিত পর্যায়ে। খুব ধারাবাহিক না।’

 

অন্য খাতগুলো রফতানিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে না পারার কারণ হিসেবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘পোশাক খাত বাদে অন্যান্য খাত অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক থেকে ঋণের সুবিধা সেভাবে পায় না। ব্যাংকগুলোও পোশাক খাতের বাইরের অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। আবার রফতানি নীতিতেও বিভিন্ন ধরনের যে সুবিধা রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই প্রকৃত সুবিধাভোগী পোশাক খাত। অন্য খাতগুলো সেভাবে সুবিধাগুলো পায় না। এছাড়া কাঠামোগত সংকট ও দক্ষ জনশক্তির অভাবও বড় ভূমিকা রেখেছে। পোশাক খাতে গত দুই দশকে যেভাবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়েছে, অন্য খাতগুলোয় কিন্তু সেভাবে হয়নি। এ দিকগুলোয় যদি যথাযথভাবে নজর দেয়া যায়, তাহলে আমরা রফতানি বৈচিত্র্যকরণের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।’