আমরা যখন ছোট তখন দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের নাম গন্ধ ছিলনা। হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান তখন রপ্তানি করত। তাও নগণ্য। তখন আমরা আমাদের বই পুস্তকে বাংলাদেশের রপ্তানির এক নম্বর খাত হিসাবে পড়তাম পাট। রচনা লিখতে দিলে পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ন রচনা ছিল পাট, লোড শেডিং, জনসংখ্যা বিস্ফরণ।
কালের আবর্তে পাট হারিয়ে গেল। অবশ্য এর জন্য বাংলাদেশকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি তৈরি পোশাকে বিপ্লব আসলো তখন। দেশের রপ্তানি বাণিজ্য দ্রুত বাড়তে থাকে সেই সময় থেকেই।
রপ্তানি সবকিছু না। আমদানী বিকল্প শিল্প, সেবা দাড় করানো রপ্তানি বাণিজ্যের থেকে কোন অংশে কম নয়।
আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান অংশিদার ছিল তখন ভারত। বাজারে কনকা বলপেন, জেল পেন থেকে শুরু করে টাটা প্যাকেট লবণ সহ প্রায় সব পণ্যে বাজার তখন ভারতের দখলে। চীন প্রধান অংশিদার হয়েছে ২০০৮ এর দিকে।
ক্যাসিও বা সিটিজেন ক্যালকুলেটর নিয়ে কথা হচ্ছিল হোম টিউটরের সাথে। তিনি তখন বলেছিলেন এই ক্যালকুলেটর এর কাভার যেটা অমশ্রিণ আবরনে ঢাকা সেটা তৈরি করার ক্ষমতাও এদেশের নাই। খুব হতাশ হতাম। সুই ও আমদানি করতে হত। দেশি সুই পাওয়া যেত যেটা মোটা। লেপ, তোষক সেলাই এর জন্য ব্যাবহার করা হত। এমনকি সবুজ ট্যাবলেট যেটা মাথা ব্যাথা জ্বরে কিনে খেতাম সেটাও যে ভারত থেকে আসত সেটা
অনেকেই বিশ্বাস করবেন না কিন্তু এটাই সত্য। আজ দেশ নিয়ে গর্ব করার অনেকেই কিছু খুজে পান না। কিন্তু আমি চাক্ষুস দেখেছি, খোজ রেখেছি।
এখন বাংলাদেশের শিল্প রপ্তানি যদিও গার্মেন্টস নির্ভর কিন্তু অনেক পণ্য এখন আমরা নিজেরাই তৈরি করি। আমদানি বিকল্প শিল্পের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে
১. ঔষধ শিল্প ( এখন দেশের চাহিদা সম্পূর্ন মিটিয়ে বাহিরে রপ্তানির পরিমান বাড়তেছে)
২. সিরামিক শিল্প ( চাইনিজ সিরামিকের কথা এখনো মনে আছে। কিছুদিন আগেও শেলটেক ভোলায় এশিয়ার সব থেকে বড় সিরামিক কারখানা করেছে ২০০০ কোটি টাকা ব্যায়ে। সিরামিক মানে এখন শুধু থালা বাসন না। টাইলস, বাথ ট্যাব, বেসিন, কমোড থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছু তৈরি হচ্ছে দেশে। আকিজ, মুন্নু, সাইনপুকুর, র্যাকের মত অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এই শিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করছে। যদিও রপ্তানি টাকা হিসাবে কম। আমদানি বিকল্প পণ্যে সয়ংসম্পূর্ন হউয়া বড় বিষয়। এর পরের স্টেজ হল রপ্তানি বাজার ধরা)
৩. কিচেন ওয়ার ( ভারতের দখলে ছিল কিচেন ওয়ারের পুরো মার্কেট। এখন অবশ্য চীনের পণ্য প্রচুর থাকলেও বাংলাদেশেই দিল্লি কিচেন ওয়ার, কিয়াম মেটালস, সহ শতাধিক ছোট বড় কোম্পানি দেশেই তৈরি করছে প্রেসার কুকার, হাড়ি, পাতিল, সহ রান্নার সব সরঞ্জাম)
৪. কেবল ( বৈদ্যুতিক কেবল থেকে শুরু করে এদেশেই সব ধরনের কেবল তৈরি করছে বাংলাদেশ। বি আর বি কেবলস, প্যারাডাইস কেবলস এর মত অনেক কোম্পানি এখন এদেশে)
৫. গ্লাসওয়ার ( পিএইচপি এর মত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন দেশের কাচের পূর্ন চাহিদা মেটাতে সক্ষম)
৬. ইলেক্ট্রনিকস ( সুইচ, কার্ট আউট থেকে শুরু করে এখন দেশেই অনেক কোম্পানি এই শিল্পে বিপ্লব করেছে)
৭. উচ্চ প্রযুক্তির ইলেক্ট্রনিকস ( ওয়ালটনের মত অনেক কোম্পানি দেশে ফ্রিজ তৈরি করছে যেই বাজার আগে পুরটাই আমদানির উপর চলত। শুধু ফ্রিজ নয়, এসি, টিভি, ইন্ডাকশন, মোবাইল, ওভেন, ফ্যান, আইরন থেকে শুরু করে এই খাতে এখন এমন পণ্য পাওয়া কঠিন যেটা দেশে তৈরি হয়না। এমনকি দেশে এখন তৈরি হচ্ছে লিফট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট। দেশের চাহিদা মিটিয়ে পরে এগুলা রপ্তানির বাজারে ভাল ভূমিকা রাখতে পারবে)
৮. মটর সাইকেল ( এই বাজারে আগের মত এখনো ভারতীয় পণ্যের দাপট। কিন্তু আগে যেখানে শুধু ভারতীয় কোম্পানিই ছিল সেখানে এখন দেশে রানারের মত কোম্পানি বেশ ভাল করছে। এমনকি বিদেশি হোন্ডা, হিরো, এর মত অনেক গুলি কোম্পানি এদেশে কারখানা করতে বাধ্য হয়েছে)
৯. অটোমোবাইল ( এই শিল্পে আমাদের এগিয়ে যাওয়া দরকার। পিএইচপি সিকেডি মেথডে উৎপাদন শুরু করেছে। চাইনিজ কোম্পানি এবং BAIL মিরসরাই ইকোনমিক জোনে কারখানা করছে। হয়ত এই শিল্প আমাদের আমদানির উপর প্রেশার কমিয়ে দিবে)
১০. জাহাজা নির্মাণ ( আগে কখনো চিন্তাও করিনি বাংলাদেশ জাহাজ তৈরি করবে। স্টেলা মেরি যেদিন রপ্তানু হয় পত্রিকা হাতে আমি চিৎকার করে সবাইকে জানাইছিলাম নিউজটা। হ্যা আমরাও পারি। আজ এই দেশে যুদ্ধ জাহাজ তৈরি হচ্ছে)
১১. অন্যান্য। দেশে এখন আমদানি বিকল্প পণ্যের লিস্ট ছোট নয়, আরএফএল, প্রাণ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, যমুনা মবিল, ওরিয়ন, ম্যাক্স, এর মত প্রচুর গ্রুপের হাত ধরে দেশ প্লাস্টিক শিল্পে সয়ংসম্পূর্ন হচ্ছে। অয়েল রিফাইনারি হচ্ছে। রেল লাইন তৈরি হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। ফুড প্রসেসিং থেকে শুরু করে বিউল্ড ট্রেড, বসুন্ধরা, BSRM, KSRM, AKS, RSRM এর মত কোম্পানি দেশকে স্টিল সেক্টরে সয়ংসম্পূর্ন করে তুলছে।
অনেক কোম্পানির নাম বাদ দিলাম। মনে করতে পারছি না।
তবে একটি বিষয় নিয়ে খুব ভাল অনুভূত হয় যে এদেশের শিল্প সক্ষমতা যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু দরকার দেশের চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানি।
আর রপ্তানির উপায় নিয়ে আমার চিন্তা ভাবনা এই পোস্টে যুক্ত করলে পোস্ট অনেক বড় হবে। তাই বাদ দিচ্ছি।
আসুন নিজ দেশকে আরো গভীর ভাবে জানার চেষ্টা করি। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।